হার্ট

হার্ট ফেইলিউর: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা

হার্ট ফেইলিউর বা হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতা এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদপিণ্ড শরীরের প্রয়োজনীয় পরিমাণ রক্ত অক্সিজেন সঞ্চালন করতে পারে না। এটি হঠাৎ ঘটে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্র দুর্বল হতে হতে একসময় সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হার্ট ফেইলিউর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে, তবে সঠিক চিকিৎসা, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন সচেতনতার মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

হার্ট ফেইলিউর কী?

হার্ট ফেইলিউর মানে এই নয় যে হৃদপিণ্ড পুরোপুরি থেমে গেছে। বরং এটি একটি ক্রনিক অবস্থা, যেখানে হার্ট পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়। ফলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, ফুসফুসে তরল জমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়।

হার্ট ফেইলিউরের কারণ

হৃদযন্ত্র ব্যর্থতার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। প্রধান কারণগুলো হলো:

. করোনারি আর্টারি ডিজিজ

হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী ধমনিতে ব্লকেজ তৈরি হলে হার্টে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। দীর্ঘদিন এই সমস্যা চলতে থাকলে হার্ট ফেইলিউর দেখা দিতে পারে।

. উচ্চ রক্তচাপ

দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হার্টকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এতে হৃদপিণ্ডের পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।

. হার্ট অ্যাটাক

হার্ট অ্যাটাকের কারণে হৃদপিণ্ডের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। এটি হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম বড় কারণ।

. কার্ডিওমায়োপ্যাথি

জন্মগত সমস্যা, সংক্রমণ, অ্যালকোহল, ড্রাগ বা অন্যান্য কারণে হার্টের পেশি দুর্বল হলে কার্ডিওমায়োপ্যাথি হয়, যা হার্ট ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

. ভালভের রোগ

হৃদযন্ত্রের ভালভ সঠিকভাবে কাজ না করলে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে হার্টকে বেশি কাজ করতে হয়, যা পরে হার্ট ফেইলিউর সৃষ্টি করে।

. ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস রোগীরা হার্ট ফেইলিউরের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। কারণ ডায়াবেটিস রক্তনালী হৃদযন্ত্রের কার্যক্রমকে দুর্বল করে দেয়।

. অন্যান্য কারণ

স্থূলতা

থাইরয়েড রোগ

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ

ধূমপান অ্যালকোহল সেবন

হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণ

হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণ ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং সময়ের সাথে সাথে তা তীব্রতর হয়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

1.শ্বাসকষ্টসামান্য পরিশ্রমেই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাতে শুয়ে ঘুমানোর সময়ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।

2.অতিরিক্ত ক্লান্তিশরীরে শক্তি কমে যায়, সহজ কাজেও প্রচুর পরিশ্রম মনে হয়।

3.পা পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়াশরীরে তরল জমে ফোলাভাব তৈরি হয়।

4.দ্রুত হৃদস্পন্দনহার্ট দুর্বল হলে দ্রুত বা অনিয়মিত বিট হতে থাকে।

5.ওজন বৃদ্ধিশরীরে পানি জমে হঠাৎ ওজন বাড়তে পারে।

6.কাশি বা শ্বাসে সাঁ সাঁ শব্দফুসফুসে তরল জমে কাশি শ্বাসকষ্ট হয়।

7.মনোসংযোগে সমস্যামস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত না পৌঁছালে বিভ্রান্তি বা মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়।

হার্ট ফেইলিউরের প্রকারভেদ

হার্ট ফেইলিউরকে সাধারণত দুইভাবে ভাগ করা হয়:

Left-sided heart failure: যেখানে হৃদপিণ্ডের বাঁ দিক সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়।

Right-sided heart failure: এখানে হৃদপিণ্ডের ডান দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরে ফোলাভাব সৃষ্টি করে।

রোগ নির্ণয়

হার্ট ফেইলিউরের সঠিক চিকিৎসার জন্য আগে রোগ নির্ণয় জরুরি। চিকিৎসক সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলো করে থাকেন:

ইসিজি (ECG): হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরীক্ষা।

ইকোকার্ডিওগ্রাম: হার্টের গঠন রক্ত প্রবাহ বোঝা যায়।

ব্লাড টেস্ট: কিডনি, লিভার থাইরয়েড ফাংশন পরীক্ষা করা হয়।

এক্সরে: ফুসফুসে তরল জমেছে কি না তা বোঝার জন্য।

স্ট্রেস টেস্ট: ব্যায়ামের সময় হার্টের কার্যক্ষমতা মূল্যায়ন।

হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসা

. ওষুধ

ডায়ুরেটিকস (Diuretics): শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল বের করে শ্বাসকষ্ট কমায়।

বিটাব্লকারস: হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

এসিই ইনহিবিটর বা এআরবি: রক্তচাপ কমিয়ে হৃদযন্ত্রকে সহায়তা করে।

ডিজিটালিস: হার্টের পাম্পিং শক্তি বাড়ায়।

. ডিভাইস সার্জারি

পেসমেকার বা আইসিডি (ICD): হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

হার্ট ভালভ রিপ্লেসমেন্ট বা বাইপাস সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে করা হয়।

হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট: যখন আর কোনো চিকিৎসায় কাজ হয় না।

. জীবনযাত্রায় পরিবর্তন

লবণ চর্বি কমানো

ধূমপান অ্যালকোহল ত্যাগ

নিয়মিত হালকা ব্যায়াম

ওজন নিয়ন্ত্রণ

নিয়মিত ওষুধ সেবন ফলোআপ

জটিলতা

হার্ট ফেইলিউর সময়মতো চিকিৎসা না নিলে নিচের জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে:

কিডনি ব্যর্থতা

লিভার ক্ষতি

অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia)

স্ট্রোক

হঠাৎ মৃত্যুঝুঁকি

প্রতিরোধ

হার্ট ফেইলিউর প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ জীবনধারা অনুসরণ করা যেতে পারে:

1.নিয়মিত রক্তচাপ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা

2.স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া

3.শারীরিক পরিশ্রম বা হালকা ব্যায়াম করা

4.ধূমপান অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা

5.নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

যদি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে দেরি না করে ঢাকার কার্ডিওলজিস্ট বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত:

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া

বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা

অনিয়মিত বা দ্রুত হৃদস্পন্দন

পা মুখ ফুলে যাওয়া

অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা মাথা ঘোরা

উপসংহার

হার্ট ফেইলিউর একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা, তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওষুধ, জীবনধারার পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে সার্জারির মাধ্যমে রোগী সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন। তবে ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো রোগ শনাক্ত করা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ যদি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা বা অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ভুগে থাকেন, তবে দেরি না করে অভিজ্ঞ ঢাকার সেরা কার্ডিওলজিস্ট বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর কাছে যান। সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে জীবনমান অনেকাংশে উন্নত করা সম্ভব।

Leave a Reply